নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন; তিনি দ্যা কান্ট্রি অফ ফার্স্ট বয়েজঃ এন্ড আদার অ্যাসেস এর লেখক। এই সাক্ষাৎকারে তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা এবং সমাজে বৈষম্য কেন বিরাজ করে- এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর সাংবাদিক অমৃত দত্ত।
সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি আপনার অনুরাগ বিষয়ে বলুন। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি আপনাকে কীভাবে নাড়া দেয়?
সংস্কৃত ও গণিত ছিল স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। যখন নোবেল কমিটি আমাকে তাদের জাদুঘরের জন্য দুটি জিনিস দান করতে বলল, আমি তাদের দিলাম আর্যভট্টের গণিতের বই, যেটি আমি স্কুলে পড়েছিলাম এবং আমার বাইসাইকেল, যা দিয়ে আমি দুর্ভিক্ষের সময়কার তথ্য সংগ্রহ করতাম।আমি বাংলার ফার্মগুলোতে এই সাইকেলে চড়ে পরিদর্শনে যেতাম এবং তাদের ধুলিজমা রুমগুলো যেখানে সব রেকর্ড রাখা হত সেগুলো খোলাতাম। এর চেয়েও বেশি আমি সাইকেলটিকে ব্যবহার করেছি লিঙ্গ বৈষম্যবিষয়ে গবেষণার সময়ে। আমি শান্তিনিকেতনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে পাঁচ এর কম বয়েসি ছেলে মেয়েদের ওজন মাপতে যেতাম ( ঐ বয়সেই মেয়ে শিশুদের ওজন ছেলেদের তুলনায় কমে যাওয়া শুরু হয়)। আমি ভেবে গর্ববোধ করি যে আমি বাচ্চাদের ওজন পরিমাপ করার কাজটি খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিলাম। আমার গবেষণার সহযোগী ছিলেন একজন অসাধারণ নারী, যিনি তার গ্রামের প্রথম সাঁওতাল হিসেবে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। একবার তিনি নতুন দাঁত উঠছে একটি শিশুর ওজন মাপতে সাহায্য করার জন্য আমাকে ডাকলেন এবং আমি কোন কামড় না খেয়েই কাজটি সম্পন্ন করেছিলাম।
অতীত আমাকে ইতিবাচকভাবে উদ্দীপিত করে। আমি প্রবলভাবে আলোড়িত হই, যখন আমি দেখি আমার মননশীল সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণীয় বিজ্ঞানে চীনের মতো প্রভাবশালী না হলেও বিজ্ঞানের দর্শন এবং এর স্বরূপ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে ব্যবহারশাস্ত্রের দর্শন নির্ণয়ে।সত্যিকার অর্থে, আমার বই আইডিয়া অফ জাস্টিস সংস্কৃত পণ্ডিতগণ কর্তৃক নির্ণীত নীতি ও ন্যায় এর প্রভেদের উপর ভিত্তি করে রচিত। আমি মনে করি কালিদাসের মেঘদুতম ভারতীয় সংস্কৃতি বোঝার একটি অপরিহার্য মাধ্যম। কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লাগে শুদ্রক রচিত নাটক মৃচ্ছকটীকা, আমার ন্যায়শাস্ত্রবোধ এই বইটি দ্বারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত। বেদশাস্ত্রও আমার ভালো লাগে, আমি মনে করি এই বইটিকে ভালো লাগানোর জন্য কাউকে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী না হলেও চলবে, এটি অসাধারণ একটি গ্রন্থ। মানুষ অজ্ঞতাবশতঃ ভাবে এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মগ্রন্থ, বস্তুত এটি মানুষের আচরণবিধি সংক্রান্ত গ্রন্থ। বেদের কিছু কিছু স্তোত্র অসম্ভব শক্তিশালী। কিন্তু গণিত বিষয়ে বেদের অবস্থান আমাকে পীড়া দেয়। কিছু ধাঁধাঁ ব্যাতিত গণিতশাস্ত্রের কোন কিছুকেই এখানে তুলে ধরা হয়নি।
১৯৬০ এর দশকে যখন আপনি নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিষয়ে নিরীক্ষণ শুরু করলেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
আমি যখন কোলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ছিলাম তখনই আমি লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে আগ্রহী হই। আমি ভাবতাম কার্ল মার্ক্সের কৃত্রিম চেতনা তত্ত্বটি নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। যখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করাচ্ছিলাম তখন এই বিষয়ে আমি কিছু গবেষণাপত্র তৈরি করি। বৈষম্য আমাকে ততোটা অবাক করেনি, যতটা করেছে এই বিষয়টিকে মানুষ যেভাবে মেনে নিয়েছে তা। আপনি যখন এ সম্পর্কে তাদের জানাতে চাইবেন, তারা আপনাকে সংস্কৃতির দোহাই দিবে। আমাকে বলা হয়েছিলো এটা একটা পশ্চিমা ভাবনা এবং ভারতীয় নারীরা কখনো তাদের পরিবার গণ্ডি পেরিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা ভাবতে পারেননা। ১৯৬০ সালে দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসে এই বিষয়ে আমি বিতর্ক করেছিলাম, আমি বলেছিলাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করার মাধ্যমে আমরা আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদকে হারাচ্ছি। এবং এভাবেই সমাজে বঞ্চিত এবং শৃঙ্খলিত শ্রেণিকে অবলম্বন করে বৈষম্য বেঁচে থাকে।
আপনি সারা জীবন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কাটালেন, কীভাবে এটাকে দেখেন?
আমার পিতা এবং পিতামহ দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। ৮১ বছর বয়সে পৌঁছেও আমি শিক্ষকতা ত্যাগ করিনি, কারণ আমি ছাত্রদের পছন্দ করি এবং তারা আমাকে পছন্দ করে। এখন যখন আমি পিছনে ফিরে তাকাই, যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয় সেটি হল আমার শিক্ষক পরিচিতি।
আপনি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কয়েক দশক ধরে লিখছেন। আপনার নিজের শিক্ষা জীবন কীরকম ছিল?
আমি অনেক সৌভাগ্যবান কারণ আমি শান্তিনিকেতনের কাছে চমৎকার একটা স্কুলে যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম। এর আগে বছরখানেকের মত আমি ঢাকায় সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়েছিলাম, যেটি ছিল শিক্ষার্থীদের ফলাফলের ব্যাপারে বেশ সচেতন । নোবেল পুরষ্কার পাবার পরে আমি স্কুলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষক আমাকে বললেন যে তারা আমার নামে বেশ কিছু বৃত্তি চালু করেছেন। তিনি আমাকে আরও বললেন যে আমার পুরনো পরীক্ষার খাতাগুলো তিনি শিক্ষার্থিদের দেখিয়েছেন যাতে করে তারা অনুপ্রাণিত হয়। আমি অবাক হলাম, কীভাবে এটা সম্ভব? প্রধান শিক্ষক আমাকে বললেন তার উদ্দেশ্য এটাই ছিল। এর পরে তিনি ক্লাসে আমার অবস্থান চেক করলেন এবং দেখলেন ৩৬ জনের মধ্যে আমার অবস্থান ছিল ৩৩ তম। আমার মনে হল তিনি এরপরে একটু দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন এই ভেবে যে ক্লাসে এটা দেখানো ঠিক হবে কিনা।
সত্যি বলতে গেলে আমি তুলনামূলক ভালো ছাত্র হয়ে উঠি শান্তিনিকেতনে যাবার পরে, যেখানে আমার গ্রেড নিয়ে কেউ চিন্তিত ছিলনা। বরঞ্চ সেখানে এটা নিয়ে ভাবাটাকে লজ্জাজনক মনে করা হত। আমার একজন শিক্ষক আমারই এক সহপাঠী সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, গ্রেড ভালো হওয়া সত্ত্বেও তার চিন্তা ভাবনায় স্বকীয়তা আছে। সেখানে প্রথম হবার জন্য কোন চাপ ছিল না, এই ব্যাপারটি আমার ভালো লেগেছিল।
সেখানে তখন আমার সাথে মেয়েরাও পড়তো (আমি ১৯৪০ সালে স্কুলে গিয়েছিলাম), শুধু তাই নয়- এর আগে আমার মাও সেখানে পড়ে গেছেন। তিনি গর্ব করে বলতেন যে ৯০ বছর আগে তিনি স্কুলে জুডো খেলেছেন। তিনি প্রথম ভারতীয় নারীদের মধ্যে একজন যিনি জুডো শিখেছিলেন। তার শিক্ষক ছিলেন একজন জাপানী, যিনি প্রথম সপ্তাহে তাদের শুধুমাত্র কীভাবে ব্যাথা না পেয়ে পড়তে হয় তাই শিখিয়েছিলেন। জুডো খেলায় যারা পড়ে যায় তাদের পরিণতি থেকে খেলার বাইরের সমগ্র মানবজাতি এবং এর সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
অননূদিত প্রবন্ধটি পড়তে ক্লিক করুন:http://blog.oup.com/2015/11/amartya-sen-education-gender-equality/